ইসমাইল মাহমুদ,ষ্টাফ রিপোর্টারঃ ক্ষমতার দাপটে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সংরক্ষিত বনের কিয়দংশ দখল করে চা বাগান করেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী এবং মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ। বন বিভাগ ২০১৮ সাল থেকে বার কয়েক সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখলে থাকা সংরক্ষিত বনের জমি উদ্ধারে প্রচেষ্টা চালালেও সফল হতে পারেনি। অবশেষে পট পরিবর্তনের পর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখলে থাকা বনের জমি উদ্ধার কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ একর জমি উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বনের জমি উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং মৌলভীবাজার রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হবার পর মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পান। সে সময়ে তিনি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের স্টুডেন্ট ডরমিটরির পাশে কিছু জমি স্বল্প মূল্যে ক্রয় করে পার্শ্ববর্তী গড়ে তুলেন ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামের একটি চা বাগান। সে সময়ে অভিযোগ ওঠে ক্ষমতার দাপটে মো. আব্দুস শহীদ নিজের কেনা স্বল্প জমির সাথে লাউয়াছড়া উদ্যানের বিপুল পরিমাণ জমি দখল করে ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ গড়ে তুলেছেন। তিনিসহ আরো কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে বনের জমি রয়েছে এমন অভিযোগও পাওয়া যায়। এর প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে বন বিভাগ লাউয়াছড়া বনের জমি ডিমারগেশনের (পরিমাপ) উদ্যোগ নেয়। কিন্তু নানা কারনে বনের জমি পরিমাপ সম্পন্ন করা যায়নি। এরপর একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও বন বিভাগ লাউয়াছড়া বনের জমি পরিমাপ করতে পারেনি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অনেক বছর ধরে ক্ষমতাবান সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ অবৈধভাবে লাউয়াছড়া বনের জমি দখল করে রাখেন। তিনি একাধিকবারের সংসদ সদস্য, সাবেক চিফ হুইপ। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বত্র তার একচ্ছত্র প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সে কারণে ২০১৮ সাল থেকে বন বিভাগ একাধিবার উদ্যোগ নিয়েও বনের জমি উদ্ধার করতে পারেনি।’ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রশাসনের সহযোগিতায় পরিমাপ শুরুর পর বন বিভাগ এ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। সে সময়ে লাউয়াছড়া বনবিট কর্মকর্তাকে ক্ষমতাবান মহল হুমকি-ধামকি প্রদান করেন। ওই মহলের হুমকি-ধামকির কারনে তিনি চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করে এ বনবিট থেকে বিদেয় নেন।’
বন বিভাগের অপর একটি সূত্র জানায়, গত বছর একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে মো. আব্দুস শহীদ কর্তৃক লাউয়াছড়া বনের জমি দখলের বিষয়টি। সে প্রতিবেদনের নিজের বক্তব্যে আব্দুস শহীদ বলেছিলেন ‘কার দখলে নেই বন বিভাগের জমি?’ ফল বাগান হয়েছে, রিসোর্ট হয়েছে বনের জমিতে’। পরবর্তীতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে এসে বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লাইভ করেছিলেন সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য ব্যরিস্টার সাইদুল হক সুমন।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদের দখলে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের বেশ কিছু জমি রয়েছে। তবে বনের ঠিক কতটুকু জমি সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখলে রয়েছে তা বনটি পরিমাপ না করা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। এতোদিন তার ক্ষমতার দাপটে আমাদের পক্ষে ওই জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে পট পরিবর্তন হওয়ায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান, আমিসহ ১৩৩ জন শ্রমিক নিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রায় পাঁচ একর বনের জমি সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখল থেকে উদ্ধার করে বন বিভাগের দখলে নেয়া হয়েছে। উদ্ধারকৃত এ জমিতে চাপালিশ, অর্জুন, বহেরা, হরিতকি, জাম, লিচু, বকুল প্রভৃতি প্রজাতির প্রায় ৫ সহস্রাধিক গাছের চারা রোপন করা হয়েছে। পরবর্তীতে লাউয়াছড়া বনের জমি পরিমাপের পর আর যদি কোন জমি সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখলে বা অন্য কারো দখলে থেকে থাকে তবে সেগুলোও উদ্ধার করা হবে।’
এ ব্যাপারে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কৃষিমন্ত্রীর দখলে কি পরিমাণ জমি রয়েছে তা ডিমারগেশনের পর নিশ্চিত হতে পারবো। তবে আমরা আমাদের লাউয়াছড়া স্টুডেন্ট ডরমেটরির পাশে অবস্থিত প্রায় ৫ একরের বেশি জমি সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখল থেকে উদ্ধার করে আমরা সে জমিতে বন্যপ্রাণীর খাদ্য উপযোগি নানা জাতের গাছের চারা রোপন করেছি। লাউয়াছড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিমাপ করে লাউয়াছড়া দখলমুক্ত করা হবে।’
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি, নানা অনিয়ম, সংসদ সদস্য হয়েও বন বিভাগের জমি দখল করে চা বাগান তৈরি এবং চা বাগানে রাস্তার লাইট ও ডিপ টিউবওয়েল সরকারি খরচে স্থাপনসহ সরকারি আইন লঙ্ঘন করেছেন প্রাথমিক তদন্তে এমন তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। গত ৮ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আখতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।