এস.এইচ. বিজয়, সিনিয়র রিপোর্টার:
শুরুটা ছিল আশার, এরপর শুধুই হতাশা…
একটি দম্পতির জীবন চলছিল একটাই স্বপ্নকে ঘিরে—সন্তান জন্ম দেওয়া। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কেটে যায় ১৮টি বছর। শত চেষ্টা করেও তাদের কোলে আসে না একটিও ফুটফুটে শিশু। ডাক্তার, হসপিটাল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা—সবই করেছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত আইভিএফ (In Vitro Fertilization) পদ্ধতিরও আশ্রয় নেন।
আইভিএফ হলো একটি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে নারী ও পুরুষের দেহের বাইরে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর নিষেক ঘটিয়ে একটি ভ্রূণ তৈরি করা হয় এবং তা নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। অনেকেই এই পদ্ধতিতে সফল হন, তবে সব সময় না। এই দম্পতির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল।
‘অ্যাজোস্পার্মিয়া’ — সমস্যা যেটি সবকিছু আটকে দিল
চিকিৎসকরা জানান, এই দম্পতির সমস্যা আরও জটিল। দুজনেরই ছিল বন্ধ্যাত্ব। বিশেষ করে পুরুষ সঙ্গীর দেহে ছিল অ্যাজোস্পার্মিয়া নামক সমস্যা। এটি এমন এক ধরনের রোগ, যেখানে পুরুষের শুক্রাশয়ে যথেষ্ট পরিমাণে শুক্রাণু উৎপাদন হয় না। স্বাভাবিকভাবে একজন পুরুষের শরীরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২ কোটির মতো শুক্রাণু তৈরি হয়। কিন্তু অ্যাজোস্পার্মিয়ায় সেই সংখ্যা হয় অনেক কম, কখনো কখনো শূন্যের কাছাকাছি।
শুধু সংখ্যা কম নয়, এসব শুক্রাণুর গুণগত মানও থাকে খুবই খারাপ। যার ফলে তা ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে না। আর এই কারণেই আইভিএফ পদ্ধতিও কাজে আসছিল না।
চিকিৎসকরা একপর্যায়ে জানিয়ে দেন—তাদের মা-বাবা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। তখন ভেঙে পড়েছিলেন তারা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) অভাবনীয় আশীর্বাদ
ঠিক তখনই আলো দেখায় আধুনিক বিজ্ঞান। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক তৈরি করেন এক অভাবনীয় এআই প্রযুক্তি— যার নাম STAR (Sperm Testing and Recognition)।
এই এআই পদ্ধতি কোটি কোটি শুক্রাণুর গঠন, গতি ও কার্যক্ষমতা বিশ্লেষণ করে নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে পারে কোন শুক্রাণুটি সবচেয়ে সুস্থ এবং ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে সক্ষম। এমন একটি কাজ, যা সাধারণ পরীক্ষায় কখনোই ধরা পড়ে না।
এই দম্পতির ক্ষেত্রেও STAR প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের নমুনা শুক্রাণুর মধ্যে থেকে মাত্র তিনটি কার্যকর শুক্রাণু আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়। এই তিনটি শুক্রাণুই ছিল তাদের শেষ সম্ভাবনা।
এরপর সেই শুক্রাণুর সাহায্যে পুনরায় আইভিএফ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। আর এ বার সফল হন তারা। গর্ভধারণ ঘটে, সময়মতো একটি সুস্থ-সবল সন্তানের জন্ম হয়।
টেস্ট টিউব বেবি — কিন্তু স্বাভাবিক শিশুই
অনেকেই মনে করেন, IVF-তে জন্ম নেওয়া শিশুরা স্বাভাবিকচ নয়। এটি ভুল ধারণা। IVF বা ‘টেস্ট টিউব বেবি’ শিশুরা আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতোই সুস্থ, স্বাভাবিক। পার্থক্য শুধু জন্মের প্রক্রিয়ায়।
প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণে সমস্যা হলে, আইভিএফ একটি বিকল্প পথ। তবে এটি ব্যয়বহুল, জটিল এবং মানসিকভাবে কষ্টসাধ্য। তার মধ্যেও যখন চিকিৎসা ব্যর্থ হয়, তখনই এআই-এর মতো প্রযুক্তি নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে।
চিকিৎসা জগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা
বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, এআই এখন কেবলমাত্র রোগ নির্ণয় কিংবা রোবটিক সার্জারিতে সীমাবদ্ধ নেই। AI এখন সন্তানের জন্মেও বড় ধরনের বিপ্লব ঘটাতে পারে।
‘STAR’ প্রযুক্তি ভবিষ্যতে অ্যাজোস্পার্মিয়ার মতো জটিল সমস্যায় আক্রান্ত দম্পতিদের জন্য নতুন দরজা খুলে দিতে পারে।
প্রযুক্তি যখন মানবতার পাশে
যেখানে মানুষ হাল ছেড়ে দেয়, সেখানে প্রযুক্তি এগিয়ে আসে মানবতার হাত ধরে। ১৮ বছর ধরে কান্না, হতাশা ও অশ্রু বয়ে আনা একটি পরিবারে এখন আনন্দ, হাসি আর ভালোবাসার জোয়ার।
তাদের কাছে AI আর শুধু যন্ত্র নয়—এ যেন মহান আল্লাহর রহমতের আরেক নাম।