২০০০ সালে ‘পরিবর্তনের অঙ্গীকার’ স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করে দেশের প্রথম বেসরকারি টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি। সেই সময় থেকেই বাংলাদেশে আধুনিক টেলিভিশন সাংবাদিকতার সূচনা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক সাইমন ড্রিং বিবিসির আদলে সংবাদ পরিবেশনের একটি কাঠামো তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে দেশের টিভি সাংবাদিকতার মূল ফর্মুলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাঁর হাত ধরেই প্রিন্ট মিডিয়া থেকে উঠে আসা একদল তরুণ সংবাদকর্মী টেলিভিশন সাংবাদিকতায় যুক্ত হন এবং ‘দৃশ্যমান গণমাধ্যমের তারকা’ হিসেবে পরিচিতি পান। পরবর্তী দুই দশকে সেই ধারা অনুসরণ করে দেশে গড়ে ওঠে কয়েক ডজন বেসরকারি টিভি চ্যানেল।
বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৫০টি, যার মধ্যে পূর্ণ সম্প্রচারে রয়েছে ৩৬টি। সম্প্রচারের অপেক্ষায় আছে আরও ১৪টি। এছাড়া তথ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়া ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিভিশন (আইপি টিভি) রয়েছে ১৫টি। সম্প্রচারের জন্য নতুন লাইসেন্সের আবেদনও বিবেচনাধীন।
টিভি সাংবাদিকতার প্রাথমিক পর্যায়ে বিবিসি-ধাঁচের কাঠামো অনুসরণের কারণে সংবাদ উপস্থাপনা, রিপোর্টারদের পোশাক, উপস্থাপনার ধরন ও দৃশ্য বিন্যাসে পশ্চিমা প্রভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আভিজাত্যনির্ভর উপস্থাপনা ও ‘হিরোইজম’-এর প্রতিযোগিতাও টেলিভিশন সংবাদকে প্রভাবিত করেছে।
গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, অতি আভিজাত্যের কারণে টেলিভিশন সংবাদ সাধারণ মানুষের জীবন ও বাস্তবতা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। টকশোভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও দলনির্ভর আলোচনার প্রবণতা বেড়ে যায়। এতে নির্মোহ বিশ্লেষণ ও গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবর্তে বিতর্কনির্ভর সাংবাদিকতা গুরুত্ব পায়।
অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দ্রুত বিকাশ টেলিভিশন দর্শকসংখ্যা ও বিজ্ঞাপনী আয় দুইই কমিয়ে দিয়েছে। সীমিত বাজারে একাধিক চ্যানেলের প্রতিযোগিতা বেসরকারি টিভি খাতকে সংকটে ফেলেছে। ফলে বেশিরভাগ চ্যানেলকেই লাভজনকভাবে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই বাস্তবতায়ও সম্প্রতি ‘নেক্সট টিভি’ ও ‘লাইভ টিভি’ নামে দুটি নতুন বেসরকারি চ্যানেলকে সম্প্রচার লাইসেন্স দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে গণমাধ্যম অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন চ্যানেলগুলো কেবল রাজনৈতিক ভাষ্য প্রচারে সীমিত থাকলে টিকে থাকা কঠিন হবে। পশ্চিমা ধারার ‘কাট-পেস্ট ফর্মুলা’ থেকে বেরিয়ে যুগোপযোগী, সৃজনশীল ও তথ্যনির্ভর সাংবাদিকতা চালু করতে না পারলে টেলিভিশন খাত আরও বড় সংকটে পড়বে।
ইয়াসির আরাফাত মিলন গণমাধ্যম কর্মী