হাসনাইন সাজ্জাদী : আজ আমরা গিয়েছিলাম এক ভিন্নতর ভ্রমণে। গন্তব্য—গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার কুমারিয়া শ্মশান। উপলক্ষ—রামায়ণের গান শোনা। সঙ্গে ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ কবি শাহেদ রহমান। বয়সে প্রবীণ হলেও তাঁর চোখে আজও ভ্রমণের কৌতূহল, লোকসংস্কৃতির প্রতি গভীর টান।
কবি শাহেদ রহমানের যাত্রা শুরু করেন সকাল ৬টায় উত্তরা থেকে। সোয়া ৬টায় আমাকে আসাদ গেট তুলে নিলেন তাঁর গাড়িতে। প্রথমে আমরা কবির গ্রামের বাড়ি তারাইল যাই। শহরের ব্যস্ততা ছেড়ে যখন গ্রামে ঢুকলাম, তখন চারপাশে সবুজের প্রশান্ত নীরবতা। কবির নবনির্মিত বাড়িতে কিছুক্ষণ ছিলাম। গ্রামবাড়ির উঠান, দূরের গাছ, আর বাতাসে ভেসে আসা মাটির গন্ধ—সব মিলিয়ে মনে হলো, এখান থেকেই ভ্রমণের আসল পাঠ শুরু।
এখানে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে আমরা রওনা দিলাম কুমারিয়ার পথে। পথ ধরে জিকের বাড়ী, তারপর দীঘরঘাতি। নামগুলোই যেন ইতিহাস আর জনপদের স্মৃতি বহন করে। কাঁচা-পাকা মিশ্রিত রাস্তা, দুপাশে খাল-বিল, ধানক্ষেত, দূরে কৃষকের ঘর—এই সবকিছু মিলিয়ে পথ যেন এক জীবন্ত লোককাহিনি।
একসময় এসে পৌঁছলাম কুমারিয়া হাটে। হাটে গাড়ি রেখে ভ্যানে চড়ে নদীর পাড় ধরে কুমারিয়া শ্মশানের পথে। নদীটি শান্ত, অথচ গভীর। কিছু পথ গেলেই দেখা গেল শ্মশানের অবস্থান। সাধারণত শ্মশান মানেই নীরবতা, মৃত্যু আর ধোঁয়ার স্মৃতি। কিন্তু আজকের শ্মশান ছিল ভিন্ন। এখানে মৃত্যুর নীরবতার বদলে বাজছিল রামায়ণের গান।
শ্মশানের ভেতরেই বসেছে রামায়ণের আসর। আসনে কালী মূর্তি। ঢোল, কাঁসর আর কণ্ঠের সম্মিলনে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ আর হনুমানের কাহিনি ভেসে আসছে বাতাসে। আগুনের ছাই আর মন্ত্রোচ্চারণের জায়গায় আজ কাব্য, সুর আর ভক্তির মিলন। জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব আর ধর্মীয় আখ্যান এখানে একাকার হয়ে গেছে।
ডান পাশের গ্রামের নাম টেকের হাট। পেছনে রেখে গেলাম কুমারিয়া হাট। দিনের বেলা কুমারিয়া হাট জীবিকার গল্প বলে, সন্ধ্যার এই সময়ে সে যেন নীরব। অনতিদূরে দর্শক—শ্মশানের গান শুনে দাঁড়িয়ে আছে। হাট, নদী, শ্মশান আর রামায়ণ—এই চারটি উপাদান মিলিয়ে তৈরি হলো এক অনন্য লোকসংস্কৃতির মঞ্চ।
বয়োজ্যেষ্ঠ কবি শাহেদ রহমান নীরবে বসে গান শুনছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল—হয়তো স্মৃতির কোনো দরজা খুলে যাচ্ছিল। মনে হলো, এই গান শুধু ধর্মীয় আখ্যান নয়, এটি বাংলার গ্রামীণ জীবনের আত্মার সুর।
বাংলার লোকসংস্কৃতি মূলত মৌখিক ধারার উপর দাঁড়িয়ে। এই সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে যুগের পর যুগ মানুষ তার বিশ্বাস, জীবনদর্শন, নৈতিকতা ও ইতিহাসকে বহন করে চলেছে। রামায়ণের গান সেই লোকসংস্কৃতিরই এক শক্তিশালী ও জীবন্ত প্রকাশ। এটি শুধু ধর্মীয় আখ্যান নয়; বরং বাংলার গ্রামীণ সমাজের জীবনবোধ, নান্দনিকতা ও সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক অনন্য দলিল।
লোকায়ত রামায়ণ ও বাংলার মাটি
রামায়ণ বাংলায় এসেছে সংস্কৃতের অনুবাদ বা অনুকরণ হিসেবে নয়, এসেছে লোকায়ত রূপে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ এই ধারার এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলেও গ্রামবাংলায় প্রচলিত রামায়ণের গান তার চেয়েও বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। এখানে রাম কোনো দূরবর্তী দেবতা নন—তিনি কৃষকের ঘরের আপন মানুষ, রাজা হয়েও মানবিক; সীতা শুধু দেবী নন—তিনি বাংলার নারীর ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রতীক।
এই লোকায়ত রামায়ণে আঞ্চলিক ভাষা, উপমা, প্রবাদ ও লোকবিশ্বাস মিশে গেছে। ফলে রামায়ণের গান হয়ে উঠেছে বাংলার মাটি ও মানুষের গল্প।
পরিবেশন ধারা ও সামাজিক পরিসর
রামায়ণের গান সাধারণত গ্রামীণ উন্মুক্ত পরিসরে পরিবেশিত হয়—মাঠে, নদীর পাড়ে, মন্দির চত্বরে, কখনো বা শ্মশানে। এই স্থান নির্বাচন নিজেই তাৎপর্যপূর্ণ। শ্মশানে রামায়ণের গান জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ও ধর্মীয় বিশ্বাসের মেলবন্ধন ঘটায়। এখানে মৃত্যু ভয় নয়, বরং জীবনের পরম সত্য হিসেবে উপস্থিত হয়।
ঢোল, কাঁসর, করতাল কিংবা একতারা—এই সরল বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে কণ্ঠনির্ভর পরিবেশনা রামায়ণের গানকে দেয় গভীর আবেগ ও নাটকীয়তা। গান ও কথকতার মধ্য দিয়ে শ্রোতারা শুধু শোনে না, অংশগ্রহণ করে—কখনো সমস্বরে ধ্বনি তোলে, কখনো চোখের জল ফেলে।
ধর্মের চেয়ে মানবিকতার পাঠ
রামায়ণের গান বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ধর্মীয় অনুশাসনের চেয়ে মানবিক মূল্যবোধকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এখানে পাপ-পুণ্যের কঠোর বিচার নেই; আছে সম্পর্কের টান, কর্তব্যবোধ, ত্যাগ আর প্রেমের গল্প। রামের বনবাস, সীতার নির্বাসন কিংবা ভরত-রামের ভ্রাতৃত্ব—সবই গ্রামীণ সমাজের নৈতিক কাঠামোর সঙ্গে মিলে যায়।
এই কারণেই রামায়ণের গান হিন্দু সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে মুসলমান শিল্পী ও শ্রোতার কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। বাংলার বহু অঞ্চলে মুসলমান গায়েনের কণ্ঠে রামায়ণের গান লোকসংস্কৃতির এক অনন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ।
মৌখিক ঐতিহ্য ও স্মৃতির সংস্কৃতি
রামায়ণের গান মূলত লিখিত নয়, মুখে মুখে বেঁচে থাকা এক ঐতিহ্য। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এই গান শেখানো হয়। ফলে প্রতিটি অঞ্চলের রামায়ণের গানে ভিন্নতা দেখা যায়—কোথাও সুরে, কোথাও কথায়, কোথাও পরিবেশনায়। এই বৈচিত্র্যই লোকসংস্কৃতির প্রাণ।
আধুনিক সময়ের ডিজিটাল সংস্কৃতির চাপে এই মৌখিক ঐতিহ্য আজ সংকটে। তবুও গ্রামবাংলার কিছু শ্মশান, নদীর পাড় বা মেলার মাঠে রামায়ণের গান আজও টিকে আছে—প্রমাণ করে, লোকসংস্কৃতি কখনো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় না, সে রূপ বদলায়।
রামায়ণের গান বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গভীর মানবিক অধ্যায়। এটি ধর্মীয় কাহিনিকে লোকজ জীবনের সঙ্গে যুক্ত করেছে, জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে সেতু তৈরি করেছে। বাংলার ইতিহাস, সমাজ ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে রামায়ণের গান তাই শুধু অতীত নয়—এটি বর্তমানের এক জীবন্ত সাংস্কৃতিক অনুশীলন।
এই গান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংস্কৃতি বইয়ে বন্দি নয়; সংস্কৃতি বেঁচে থাকে মানুষের কণ্ঠে, স্মৃতিতে ও সমবেত শ্রবণে। আর সেই ধারাবাহিকতার এক উজ্জ্বল নাম—বাংলার রামায়ণের গান।
দুপুর পার হবার আগেই আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু শ্মশানের সেই গান, কুমারিয়া নদীর জল, টেকের হাটের নীরবতা—সবকিছু মনের ভেতর রয়ে গেল দীর্ঘ সময়ের জন্য। আজকের ভ্রমণ আমাদের শিখিয়ে দিল, জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানেও গান থাকে, গল্প থাকে, আর থাকে মানুষের চিরন্তন বিশ্বাস।
এই ভ্রমণ শুধু পথের ছিল না—এ ছিল সময়, সংস্কৃতি ও আত্মার ভেতর দিয়ে এক অনন্য যাত্রা।